মঙ্গলবার, ৩০ মে ২০২৩, ০৫:৪০ অপরাহ্ন
এক ইউনিয়নেই ১১ ইটভাটা!
রামগঞ্জের ভোলাকোট ইউনিয়নের কৃষি জমি ও চাষাবাদের সব জমির মাটি চলে গেছে স্থানীয় ১১ ইটভাটায়। একই গ্রামের কয়েক কিলোমিটারের মধ্যে রয়েছে ১১টি ইটভাটা। ভাটাগুলোর কারনে ধুলো-বালি আর ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন থাকে পুরো গ্রাম। কৃষি জমির মাটি (টপ সয়েল) কেটে বিক্রি করা হচ্ছে ইট ভাটাগুলোতে। ফলে উক্ত এলাকার হাজার হাজার একর কৃষি ও চাষাবাদের জমিগুলো এখন পুকুরে পরিনত হয়েছে।
এছাড়া সরকারী বরাদ্ধে সদ্য নির্মিত সড়ক দিয়ে ইট ও মাটিবাহী ট্রাক, ট্রলি, হ্যান্ডট্রলি ও পিকআপের কারনে ধ্বংস হচ্ছে গ্রামীন সড়ক পথ। অপরদিকে প্রচ- ধুলোবালি ও ট্রলি চাকায় বিধ্বস্ত রাস্তার কারনে উক্ত ইউনিয়নের সড়কগুলোতে চলাচল দায় হয়ে পড়েছে স্থানীয় এলাকাবাসীর।
স্থানীয় এলাকাবাসী আবদুস সালাম, ফারুক সালেকিন ও সালাউদ্দিন মেজবাহ জানান, এর মূলত কারন ইটভাটা। রাজারামপুর গ্রামে ২টি, নোয়াপাড়া গ্রামে ২টিসহ পুরো ইউনিয়নজুড়ে রয়েছে ১১ ইটভাটা। শুধুমাত্র দেহলা গ্রামেই রয়েছে ৪টি ইটভাটা। দেহলা গ্রামে একটি সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়সহ কয়েকশ পরিবারের বসবাস।
ইটভাটার ছাই ও ধুলোবালির কারনে গ্রামের পুরো চিত্রই পাল্টে গেছে। ইটভাটার সাথে সম্পৃক্ত মাটি ব্যবসায়ীদের কারনে এ এলাকায় এখন ধানসহ কোন চাষাবাদ হচ্ছে না। চাষাবাদের হাজার হাজার একর ফসলি জমি পরিনত হয়েছে পুকুরে।
এ চিত্র লক্ষ্মীপুরের রামগঞ্জ উপজেলার ৯ নম্বর ভোলাকোট ইউনিয়নের।
জেলার রামগঞ্জ উপজেলা শহর থেকে ৭ থেকে ৮ কিলোমিটার দুরে ভোলাকোট ইউনিয়ন। রাজারামপুর, নোয়াপাড়া, আথাকরা, নাগমুদ, টিউরি, হাঁপানিয়া, ভোলাকোট, লক্ষ্মীধরপাড়া ও দেহলা গ্রামসহ কয়েকটি গ্রাম নিয়ে গঠিত এ ইউনিয়নটি। এ ইউনিয়নে বসতিও অনেক। জনসংখ্যা প্রায় ৪০হাজার। সরেজমিনে ভোলাকোট ইউনিয়নের বিভিন্ন গ্রাম ঘুরে দেখা যায় এ চিত্র।
সরকারী আইনের তোয়াক্কা করছেন না কোন ইটভাটার মালিকগণ। সবগুলো ইটভাটার পাশে শত শত লোকজনের বসত বাড়ি ও কৃষিজমি। রয়েছে স্কুল ও মাদ্রাসাসহ বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। ভাটা নির্মাণ বন্ধের দাবিতে স্থানীয় লোকজন মানববন্ধন করে প্রশাসনের নিকট অভিযোগ দিলেও কারো কোন দায় নেই বলেও অভিযোগ করেন স্থানীয়রা। আইন অমান্য করে গত ১৫ বছরে রামগঞ্জ উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় গড়ে উঠেছে ২৭টির মতো ইটভাটা।
বিষয়টি নিয়ে পরিবেশ অধিদপ্তর নোয়াখালীর সহকারী পরিচালক তানজির তারেক ইবনে সিদ্দিক জানান, আইন অনুযায়ী ফসলি বা কৃষিজমিতে ইটভাটা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ ও ৪০ পরিবার নিয়ে গঠিত গ্রামের ২ কিলোমিটার, স্কুল-কলেজ-রেলপথ ও হসপিটালের ১ কিলোমিটারের ভিতরে কোন ইটভাটা স্থাপনা করা যাবে না। ফসলি জমির মাটি দিয়ে ইট তৈরিও নিষিদ্ধ করেছে সরকার। ইট প্রস্তুত ও ভাটা স্থাপন (নিয়ন্ত্রন) আইন ২০১৩-এর৫ (১) ধারা ও সংশোধিত ২০১৯ অনুযায়ী ইট তৈরির জন্য পাহাড়, টিলা ও কৃষিজমি থেকে মাটি নেওয়ার কোনো সুযোগ নেই। এই আইন লঙ্ঘনের জন্য সর্বোচ্চ দুই বছর কারাদন্ড বা দুই লাখ টাকা জরিমানা বা উভয় দন্ডের বিধান রয়েছে।
আথাকরা গ্রামের ইসমাইল হোসেন জানান, এ ইউনিয়নে ১১টি ইটভাটা। ভাটার কারণে (নভেম্বর-মে) স্থানীয় লোকজন চরম দুর্ভোগে বসবাস করেন। ভাটার ধোঁয়ায় বাতাস দুষিত হচ্ছে, বিভিন্ন রোগ বালাইয়ের প্রাদূর্ভাবও রয়েছে। গত কয়েকবছর আগে তাঁর গলায় চর্ম রোগ দেখা দেয়। অনেক ডাক্তার দেখিয়েছেন। কিন্তু কাজ হচ্ছে না। বর্ষা মৌসুমে ভাটা বন্ধ থাকলে, তাঁর চর্ম রোগ কিছু কমে যায়।
দেহলা গ্রামের গিয়াস উদ্দিন জানান, আমির হোসেন ডিফজলের ইটভাটায় তাঁর কয়েক শতাংশ জমি দখল করে রাখা হয়েছে। ইটভাটাগুলোর কারণে গ্রামের মানুষের কষ্টের শেষ নেই। ইটভাটার মাটি ও ইট নিয়ে প্রতিদিন কয়েক শতবার ট্রলি-ট্রাক ও পিকআপ চলাচলের কারণে গ্রামের রাস্তাগুলোর অবস্থা ভয়াবহ। নতুন করে সড়কগুলোর বেশিরভাগ সংস্কার করা হলেও ভাটার ইট ও মাটি আনা নেয়ার কারনে সরকারী সে সব সড়ক ভেঙ্গে একাকার।
ইটভাটার মালিক আমির হোসেন ডিফজল, মুরাদ হোসেন ও জাহাঙ্গীর হোসেন জানান, ইটভাটাগুলো আগেই করা হয়েছে। তখন গ্রামে বসতি কম ছিল। আর সরকারী সকল নিয়মকানুন মেনেই ইটভাটা স্থাপন করা হয়েছে বলেও দাবী করেন তারা।
উপজেলা ব্রীক ফিল্ড মালিক সমিতির সভাপতি ও মেসার্স এস এস ব্রীক ফিল্ডের মালিক মোঃ সানাউল্ল্যাহ জানান, আমরা যেভাবে ইট পোঁড়াই তাতে পরিবেশের ক্ষতি হওয়ার কথা না। আমরা অনেক দুর থেকে মাটি এনে ইট বানাই। কৃষি বা চাষাবাদের জমির মাটি দিয়ে ইট না বানালে কি দিয়ে বানাবো বলে মোবাইল লাইন কেটে দেন।
পরিবেশে অধিদপ্তর নোয়াখালীর উপ পরিচালক তানজির তারেক ইবনে সিদ্দিক আরো জানান, স্থানীয়দের অভিযোগের ভিত্তিতে মঙ্গলবার (২৫ মে) বিকালে সরেজমিনে তদন্ত করে জমির মাটি ব্রীক ফিল্ডে নেয়ার সত্যতা পেয়ে ভ্রাম্যমান আদালতের মাধ্যমে মেসার্স মাহার ব্রীক, মক্কা ব্রীক ও এস এস ব্রীক ফিল্ড মালিককে মালিককে সাড়ে ৫লক্ষ টাকা জরিমানা করা হয়েছে।
রামগঞ্জ উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা সৈয়দ রায়হানুল হায়দার জানান, ভাটাগুলোর কারনে জমির চাষাবাদ ব্যহত হচ্ছে। মাটির উপরের অংশ (টপ সয়েল) নিয়ে যাওয়ার কারনে ফসল উৎপাদন আগের তুলনায় অর্ধেকে নেমেছে। জমির মালিক হলেও তিনি কিন্তু তিনি কৃষি জমির মাটি বিক্রি করতে পারেন না। আমি স্থানীয় কৃষকদের মাটি বিক্রি করতে বরাবরাই নিরুৎসাহিত করছি। উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সাথে কথা বলে ব্যবস্থা নেয়া হবে বলেও তিনি জানান।
রামগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) তাপ্তি চাকমা জানান, ইটভাটাগুলো আগেই গড়ে উঠেছে। উক্ত ইউনিয়নে নতুন করে ইটভাটা নির্মানের প্রস্তাব স্থগিত রাখা হয়েছে। ইতোমধ্যে ভ্রাম্যমাণ আদালতে বেশ কয়েকটি ভাটা মালিকের মালিকের জরিমানা করা হয়েছে। সম্প্রতি নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট কৃষি জমির মাটি কাটা ও ব্রীজের মুখ ভরাট করে ভাটার কার্যক্রম অব্যাহত রাখায় মোরশেদ ব্রীকস ও সানাউল্লাহ ব্রীকসসহ কয়েকটি ইটভাটা মালিককে ৭লক্ষ টাকা জরিমানা করা হয়েছে।