বৃহস্পতিবার, ০১ জুন ২০২৩, ০৭:২০ পূর্বাহ্ন
লক্ষ্মীপুর জেলা জুড়ে জলবায়ু পরিবর্তনে দুশ্চিন্তার ভাজ পড়েছে সয়াবিন চাষীদের চোখেমুখে। গত বছর লক্ষ্মীপুর জেলায় ৪৮ হাজার ৫৪৫ হেক্টর জমিতে ৮৬ হাজার ৪১০ টন সয়াবিন উৎপাদিত হয়। এ সময় সারাদেশে ৮০ হাজার ৪২২ হেক্টর জমিতে এক লাখ ৪৪ হাজার ৪৭৯ টন সয়াবিন উৎপাদন হয়।
পরিবহন সংকট, প্রাকৃতিক দূর্যোগে স্থানীয় কৃষক এবং কৃষিপণ্য ব্যবসায়ীরা জানান, ২০১৯ সালের আগের চার বছরই ফসল কেটে ঘরে তোলার কয়েকদিন আগে কালবৈশাখী ঝড় ও বৃষ্টির কবলে পড়ে সয়াবিন। এতে হাজার হাজার কৃষক পুঁজি হারায়। অনেকেই ঋণগ্রস্থ হয়ে পড়ে। আতঙ্কিত কৃষকরা।
লক্ষ্মীপুরের রায়পুর উপজেলার মেঘনা উপলকূলবর্তী অঞ্চলে জেগে ওঠা বিস্তীর্ণ ৫টি চর ও ৪টি ইউনিয়নে হাজার হাজার একর জমিতে সয়াবিনের চাষ হয়।
চর ইন্দুরিয়া, কানিবগারচর, জালিয়ারচর, চরঘাশিয়া, চর কাচিয়ার চরে এবং উত্তর চর আবাবিল, দক্ষিন চর আবাবিল, উত্তর চরবংশী ও দক্ষিন চরবংশী ইউনিয়নে এবার সয়াবিনের প্রচুর ফলন হওয়ার কারনে এখানকার কৃষকের মুখে হাসি ফুটে উঠেছে। হাজার হাজার একর জমিতে চাষ হওয়া সয়াবিনের সবুজ চারা যেন নতুন এক আবহের সৃষ্টি করেছে। বর্তমানে এটি রায়পুর উপজেলা সহ লক্ষ্মীপুর জেলার প্রধান অর্থকরি ফসল হিসেবে পরিচিত। ফলে এখানে সয়াবিনের চাষাবাদ দিন দিন জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। সয়াবিন চাষ দিন দিন বিকশিত হচ্ছে। বর্তমানে জাতীয় উৎপাদনের প্রায় ৭০ ভাগ সয়াবিন এ জেলায় উৎপাদিত হচ্ছে। সয়াবিন চাষে সংকটের জন্য চাষীরা অসময়ের বৃষ্টি এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগকে দায়ী করেছেন। তবে বিশেষজ্ঞরা বিষয়টিকে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব হিসেবে চিহ্নিত করেছেন।
রায়পুর উপজেলা কৃষি অফিস সূত্রে জানা যায়, রায়পুরে মোট ৭ হাজার ৩৭৯ হেক্টর জমিতে সয়াবিন আবাদের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করলেও আবাদ হয়েছে প্রায় ৭ হাজার ৩০০ হেক্টর। প্রতিবছর এ উপজেলায় সয়াবিন মৌসুমে ৩৫০ কোটি টাকার উপরে সয়াবিন বেচাকেনা হয়। এবার আবহাওয়া অনুকূলে থাকলে বাম্পার ফলনের কারনে এর মাত্রা ছাড়িয়ে যেতে পারে বলেও জানা গেছে।কৃষক ও কৃষি বিভাগের কর্মকর্তারা জানান, জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি মাস হলো সয়াবিন আবাদের উপযুক্ত সময় ছিলো। সার ও কীটনাশক তেমন দিতে না হওয়ায় এবং আগাছা কম থাকায় এর উৎপাদন খরচও অনেক কম। আগামী মার্চ – এপ্রিল এর মধ্যে পাকা সয়াবিন ঘরে তুলতে পুরোদমে ব্যস্ত হয়ে পড়বেন এখানকার ব্যবসায়ী, মজুর ও কৃষকরা।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্যমতে, গত বছর (২০২০) সারাদেশে উৎপাদিত সয়াবিনের ৫৯.৮০ ভাগ হয় লক্ষ্মীপুরে। ২০১৯ ও ১৮ সালে উৎপাদিত হয়েছিল ৬৫ ভাগ, ২০১৭ সালে ৬০ ভাগ এবং ২০১৬ সালে ৫০ ভাগ। পরিসংখ্যান বলছে, প্রতিবছর লক্ষ্মীপুরে সয়াবিন উৎপাদন ক্রমান্বয়ে হ্রাস পাচ্ছে। অন্যদিকে গত বছর কৃষক পর্যায়ে সয়াবিন সর্বোচ্চ বিক্রি হয়েছিল টনপ্রতি ৩৭ হাজার ৫০০ টাকায়। সে হিসেবে গত বছর সয়াবিন থেকে লক্ষ্মীপুরের আয় হয়েছিল কয়েকশ কোটি টাকা।
সবচেয়ে বেশি সয়াবিন উৎপাদনকারী উপজেলা রামগতি; জেলার পাঁচটি উপজেলায়ই কম-বেশি সয়াবিন চাষ হয়ে থাকে। কিন্তু পরিসংখ্যানে দেখা যায় কমলনগর ও রামগতি উপজেলায় সবচেয়ে বেশি সয়াবিন চাষ হয়ে থাকে। সয়াবিন চাষের সাথে দু’উপজেলাতে প্রায় ১ লাখ প্রান্তি কৃষক প্রত্যক্ষ ভাবে জড়িত।
পরের অবস্থান রয়েছে সদর ও রায়পুর উপজেলা। নি¤œাঞ্চল হওয়ায় রামগঞ্জ উপজেলায় সয়াবিন চাষ কম হয়। এ বছর রামগতি উপজেলায় ১৮ হাজার ৭শ ১২ হেক্টর, কমলনগর উপজেলায় ১৪ হাজার ২শ, রায়পুর উপজেলায় ৬ হাজার ৬শ ৫, সদর উপজেলায় ৪ হাজার ১শ৭৫ এবং রামগঞ্জ উপজেলায় ১শ হেক্টর জমিতে উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারন করা হয়েছে। যার মধ্যে ফেব্রুয়ারির মধ্য সপ্তাহ পর্যন্ত জেলায় সয়াবিন চাষ হয়েছে ৩৮ হাজার ৪৭ হেক্টর জমিতে। ফেব্রুয়ারি শেষ নাগাত নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে অনেক বেশি জমিতে সয়াবিনের চাষ হয়েছে।
অন্যদিকে স্থানীয়ভাবে জানা যায়, সয়াবিন উৎপাদনে শীর্ষে থাকার কারণে ২০১৫ সালে বাংলাদেশ সরকার উপকূলীয় জেলা লক্ষ্মীপুরের ‘ব্র্যান্ডিং নাম’ রাখে সয়াল্যান্ড। ওয়ার্ল্ড এটলাসের তথ্যমতে, বাংলাদেশ সয়াবিন উৎপাদনে বিশ্বের ৩৫তম দেশ। বাংলাদেশে সয়াবিন উৎপাদনে প্রধান জেলা লক্ষ্মীপুর।
২০১৭ সালে পাঁচ উপজেলা নিয়ে গঠিত লক্ষ্মীপুর জেলা ‘সয়াল্যান্ড’ নামে বিশেষ মর্যাদা লাভ করে। বিগত বছরগুলোতে সয়াবিন থেকে লক্ষ্মীপুরের বার্ষিক গড় আয় ছিল ৩ কোটি টাকা।
বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের (বিএআরআই) নোয়াখালী অঞ্চলের সরেজমিন গবেষণা বিভাগের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. মুহাম্মদ মহীউদ্দীন চৌধুরী বলেন, অসময়ে অস্বাভাবিক বৃষ্টিপাত এবং ঝড় মূলত জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব। আর জলবায়ু পরিবর্তনের সে প্রভাব সরাসরি রবি শস্য সয়াবিনের ওপর আঘাত হেনেছে। এতে সয়াবিন চাষ তীব্র সংকটের দিকে যাচ্ছে। তিনি আরও বলেন, এর কারণ হিসেবে ‘সয়াল্যান্ড’ প্রসিদ্ধ একক রবি ফসলের জেলা লক্ষ্মীপুরে সয়াবিন চাষ বিলীন হওয়ার উপক্রম হয়েছে। এ পরিস্থিতি মোকাবেলার জন্য তিনি স্বল্প মেয়াদী সয়াবিন জাত আবিষ্কারের জন্য বিজ্ঞানীদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন।